মধ্যবিত্তের অসহায়তা: চিররঞ্জন সরকার
- আপলোড সময় : ০৭-১২-২০২৪ ০৯:৩০:২০ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৭-১২-২০২৪ ০৯:৫৪:১০ পূর্বাহ্ন
আমরা যাঁরা লেখাপড়া জানা মানুষ, তাঁরা ‘মধ্যবিত্ত’ কথাটি প্রায়ই ব্যবহার করে থাকি। এমনিতে বিত্তের দিক থেকে যাঁরা মাঝে থাকেন, তাঁরাই মধ্যবিত্ত। যদিও মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা কঠিন। সাধারণভাবে দৈনিক আয়সীমার ভিত্তিতে বিশ্বের জনগোষ্ঠীকে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করার রীতি আছে। পিউ রিসার্চ সেন্টার মধ্যবিত্ত ও অন্যান্য ক্যাটাগরির জন্য একটি মান নির্ধারণ করেছে। যেমন চার সদস্যের একটি পরিবারের দৈনিক আয় যদি ১০ ডলার ১ সেন্ট থেকে ২০ ডলারের মধ্যে হয়, তবে তারা মধ্যবিত্ত। এ হিসাবে এই শ্রেণির মানুষের বার্ষিক আয় ১৪ হাজার ৬০০ থেকে ২৯ হাজার ২০০ ডলার। আর বাকি শ্রেণিগুলোর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে- দৈনিক ২ ডলার বা এর কম আয় হলে দরিদ্র, ২ ডলার ১ সেন্ট থেকে ১০ ডলারের মধ্যে আয় হলে নি¤œ আয়ের, ২০ ডলার ১ সেন্ট থেকে ৫০ ডলার হলে উচ্চমধ্যবিত্ত এবং ৫০ ডলারের ওপর হলে তাকে উচ্চবিত্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যদিও এই হিসাবটি অনেক পুরোনো। যাঁরা পূর্ণাঙ্গভাবে সব মৌলিক চাহিদা (খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান) পূরণ করতে সক্ষম এবং যথেষ্ট অর্থ জমা স¤পদ আছে তাঁরা ধনী, যাঁরা অর্ধেক পারে এবং কিছু অংশ জমা বা স¤পদ আছে তাঁরা মধ্যবিত্ত এবং যাঁরা সামান্য অথবা চার-পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে, একটি পূর্ণ করলে আরেকটি বাদ থেকে যায়, স¤পদ বা জমা বলতে সামান্য অংশ হাতে থাকে তাঁরা গরিবের তালিকায়। গরিবদের উন্নতির জন্য সরকার অনেক প্রকল্প গ্রহণ করে। যদিও তাতে গরিবের খুব একটা উপকার হয় না। বিষয়টি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। ধরা যাক, আপনার জল রাখার একমাত্র বালতিটি ফুটো হয়ে গেছে এবং তা দিয়ে জল পড়ছে। তা দেখে আপনার এক প্রতিবেশীর খুবই কষ্ট হলো। সে দয়াপরবশ হয়ে এক বালতি জল এনে আপনার ওই ফুটো বালতিতে ঢেলে দিল, যাতে আপনার উপকার হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আপনার বালতিটি জলশূন্য হয়ে যাবে। দয়ালু প্রতিবেশী আপনাকে সাহায্য করল ঠিকই, কিন্তু সেটা আপনার কোনো কাজে এল না। যদি সে বালতির ফুটোটা বন্ধ করে দিত তাহলে আপনার কাজে লাগত। তেমনি সরকারের তো অনেক প্রকল্প আছে কিন্তু তা গরিব মানুষের উন্নতিতে কোনো কাজে আসে না। মধ্যবিত্ত কারা - এ নিয়েও বিতর্ক আছে। মধ্যবিত্তের মধ্যে আবার ভাগ আছে- উচ্চমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নি¤œমধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্তের একটা ছোট অংশ বিভিন্ন অর্থনৈতিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে উচ্চমধ্যবিত্তে পৌঁছে গেছে। আমরা যদি ওই অংশটাকে গোনায় ধরি, যাঁদের সীমিত আয় এবং যাঁরা পেশাজীবী - দেখা যাবে, গত কয়েক বছরে এই অংশটার মধ্যে একটা ভাঙন এসেছে। অর্থনৈতিক অবনতির কারণে মধ্যবিত্ত আজ বড় অসহায়। তারা না ট্রাকের চাল নেওয়ার লাইনে দাঁড়াতে পারে, না ঋণ করে খেয়ে শোধ করতে পারে। আবার সরকারি সুযোগ ভোগ করতেও মধ্যবিত্তের সম্মানে বাধে। জমানো টাকা শেষে তাদের একটা বড় অংশ এখন সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনীর বাইরে চলে যাচ্ছে। এ অবস্থা তুলে ধরছে এক অস্থির সামাজিক বাস্তবতা। আসলে যে প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশে বর্তমানে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে, সেটিই সমস্যাপূর্ণ। পাকিস্তান আমলে আমাদের দেশে মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে গ্রামের কৃষিভিত্তিক পরিবার থেকে আসা শিক্ষিতদের মাধ্যমে। কারণ, তাঁরা জানতেন, ব্যবসা করে তাঁরা মধ্যবিত্তে যেতে পারবেন না। ভালো করে পড়াশোনা করার মধ্য দিয়েই কেবল তা সম্ভব। যে কারণে ওই মধ্যবিত্তের মধ্যে একটা বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা কাজ করেছে। এটি সে অর্থে একটি গুণগত বর্গ, শুধু আর্থিক বর্গ নয়। বাংলাদেশ পর্বে তা দেখা যায়নি। শিক্ষার মান কমে যাওয়া এবং জনতুষ্টিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে মধ্যবিত্তের বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গাটা খর্ব হয়েছে। তখনকার মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখনকার মতো ভঙ্গুর ছিল না। কোনো দুর্যোগ এলেই তাদের অবস্থান নিচে নেমে যেত না। এখনকার পেশাজীবী, মধ্যবিত্তের পুঁজি হলো আর্থিক, বুদ্ধিবৃত্তিক নয়। বিভিন্ন আর্থিক দুর্যোগের সঙ্গে তাদের অবস্থান পরিবর্তিত হয়। তাদের অবস্থা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। নদীতে নাক বরাবর পানিতে দাঁড়িয়ে থাকলে যে অবস্থা হয়, তাদের অবস্থাটা এমনই। হালকা ঢেউ লাগলেই তলিয়ে যায়। মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রকৃত আয় কমে গেছে। তাদের একটা বড় অংশ কোনো সুযোগ গ্রহণ করতে না পেরে নি¤œমধ্যবিত্ত বা নি¤œবিত্তে নেমে গেছে। আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম, পৃথিবীর অন্যতম কম। গত ১০-১৫ বছরে চাহিদার মধ্যেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। যেমন মোবাইল, ইন্টারনেট, ক¤িপউটার-ল্যাপটপ একটা সময়ে বিলাসিতা ধরা হতো, এখন তা জরুরি খরচ। এসব চাহিদার সঙ্গে আছে গণপরিবহনের খরচ বৃদ্ধি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশছোঁয়া দাম। পেট্রল-গ্যাস-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক নয়, তবে এগুলোর মজুত ক্রমাগত কমছে। চাল, ডাল, তেল, নুন তো দেশে উৎপাদন হচ্ছে, আমদানিও হচ্ছে। তবে খাদ্যশস্যের দামে নিয়ন্ত্রণ নেই। দিন আনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর যে কী নিদারুণ হাল, তার খবর কেউ রাখছে না। মানুষ কিছু খাক বা না খাক, ভাত বা রুটি তার প্রয়োজনই। ৫০-৬০ টাকার নিচে এক কেজি চাল পাওয়া যায় না। একটু ভালো মানের চাল ৮০-৯০ টাকা। গম থেকে হয় আটা, আর এই আটার চাহিদার বেশির ভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তাহলে প্রশ্ন, এ দেশে কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি বিভাগ করেটা কী? সবকিছু প্রয়োজনের তুলনায় কম করে বাজার করা যায় কিন্তু সংসারে চাল, আটা, ডাল, নুন, তেল কম কীভাবে নেওয়া যায়? ওষুধপত্রের দাম বাদ দিলাম। দুমুঠো ভাতের জন্য আজ হাহাকার। যারা নি¤œবিত্ত পর্যায়ের, তাদের তো রেশনে চাল দেওয়ার ব্যবস্থাও নেই। মাঝেমধ্যে হঠাৎ হঠাৎ ট্রাক আসে, সেখানে গিয়ে চাল সংগ্রহ করতে হয় যৎসামান্য কম দামে। মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশই থাকে ভাড়া বাড়িতে। বাড়িভাড়া বেড়েছে ব্যাপক পরিমাণে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুটি প্রধান খরচ- শিক্ষা ব্যয় ও চিকিৎসা ব্যয়। মধ্যবিত্তকে প্রতিনিয়ত অতিরিক্ত খরচ সামলাতে গিয়ে একটা বিকল্প খরচের পথ সন্ধান করতে হয়। এর একটা উপায় হলো, পরিবারের একাধিক সদস্যের শ্রমবাজারে প্রবেশ করা। এ জন্য সুযোগ থাকলে মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই শ্রমে যুক্ত হতে দেখা যায়। দুজন কাজ করেও কুলানোটা কষ্টকর হয়ে যায়। সরকারি কর্মকর্তারাও এই বেতনে খুব ভালো অবস্থায় থাকতে পারেন না। তবে তাঁদের অনেকেই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নেন অথবা অনৈতিক আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেন। ফলে তাঁরা অনেকেই ভালো অবস্থায় থাকতে পারেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা মিডিয়ায় কাজ করাদের জন্য কর্মঘণ্টার কোনো শেষ নেই। তাঁদের মূল কাজের বাইরে একটা বাড়তি আয়ের চিন্তা করতে হয়। একজনের আয় দিয়ে এখন মধ্যবিত্তের জন্য চলা সম্ভব নয়। তাই তাঁকে সব সময় একটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকতে হচ্ছে। সব সময় ভবিষ্যৎ নিয়ে, সন্তানদের নিয়ে চিন্তা করাটা এখন মধ্যবিত্তের বাস্তবতা। এর ফলে মধ্যবিত্তরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। অতিরিক্ত কাজ ও পুষ্টিহীনতার কারণে মানসিক চাপ বাড়ছে। এর ফলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ফুসফুস, কিডনির রোগ বা ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। তবে মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের যে কী সমস্যা তা বলে বোঝানো যায় না। তাঁরা না ট্রাকের চাল নেওয়ার লাইনে দাঁড়াতে পারেন, না ঋণ করে খেয়ে শোধ করতে পারেন। আবার সরকারি সুযোগ ভোগ করতেও মধ্যবিত্তের সম্মানে বাধে। এককথায় পেটে খিদে মুখে লজ্জা। সবজির বাজারে আগুন। আলুর দাম ৭০-৮০ টাকা। ৫০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। অন্যান্য সবজি দামে পিছিয়ে নেই, বরং এগিয়ে। একদল ব্যবসায়ী মুনাফার জন্য অসাধু উপায় অবলম্বনে ব্যস্ত। কিন্তু মধ্যবিত্তরা আজ বড় অসহায়। অর্থনৈতিক অবনতিতে সবচেয়ে ক্লিষ্ট হয় তারা। মুখে বলার জো নেই। স্বপ্নের পক্ষিরাজের ডানায় ভর করে মিথ্যে জীবনযাপন করে চলতে হয়। আফসোস, তাদের যন্ত্রণা বোঝার মতো কেউ নেই! [চিররঞ্জন সরকার, গবেষক ও কলামিস্ট]
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ